মোঃ তারিক বিন আজিজের দৃষ্টিতে জিয়াউর রহমানের রাজনীতি: কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

- Update Time : ০৯:৫০:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৬০৩ Time View
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে রাজনৈতিক দর্শনের সূচনা করেছিলেন, তা বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করেছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সকল ধর্ম ও জাতিসত্তার মানুষ সমতার ভিত্তিতে বসবাস করে। তাঁর প্রবর্তিত “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” এর ধারণা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়, বরং সমগ্র জাতির সমন্বয় ও উন্নয়নের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করার সময় “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের” যে দর্শন উপস্থাপন করেন, তাতে সাতটি মৌলিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল :
- আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের ভূখণ্ড
- ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিক
- রাষ্ট্রের প্রধান ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা
- বাংলাদেশের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি
- উপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তি
- প্রত্যেকের নিজ ধর্ম পালনের অধিকার
- ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল সকল ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার মানুষের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ “শোষণমুক্ত সমাজ” গঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যেখানে থাকবে “সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার” । তাঁর মতে, “ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে জনগণ” এই জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি ।
জিয়াউর রহমান তাঁর এক বক্তব্যে স্পষ্ট করেছিলেন: “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণমুক্ত সমাজ, যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার”।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (বাকশাল) প্রতিষ্ঠার পর জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন । তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের বৈধতা দেন এবং ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল বিধি জারি করেন, যা মাধ্যমে আওয়ামী লীগ, বাম ও ডানপন্থি শক্তিগুলো আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায় ।
১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে যুক্ত হয় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এবং জাতীয়তাবাদ নতুন সংজ্ঞা পায় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ । এই পরিবর্তনগুলো ছিল বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন,但同时 ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল।
জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা অন্যান্য জাতীয়তাবাদ থেকে ভিন্ন ছিল। তাঁর মতে, আরব জাতীয়তাবাদ বা জার্মান জাতীয়তাবাদ ছিল ভাষা বা ধর্মভিত্তিক, কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হলো “সার্বিকভিত্তিক” যাতে জাতিগত চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিক বোধ, অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের উন্মাদনা একসাথে সমন্বিত ।
তিনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কৌশলগত গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে বলেছিলেন: “বাংলাদেশ এ উপমহাদেশের ও এ অঞ্চলের সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে… বাংলাদেশের ছিল এক বিরাট ‘স্ট্রাটেজিক’ অবস্থান এবং বলাবাহুল্য যে, সেই অবস্থান আজও গুরুত্বপূর্ণই রয়ে গেছে” ।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে কিছু বিতর্কও exists। কিছু বিশ্লেষকের মতে, তিনি রাজনীতিতে বিভক্তির সূচনা করেছিলেন । জামায়াতে ইসলামীসহ যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাদের পুনর্বাসন করেছিলেন বলে কিছু সমালোচনাও রয়েছে ।
জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে রয়েছে। তাঁর বিধবা খালেদা জিয়া একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁর পুত্র তারেক রহমান বর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ।
বিএনপির একটি ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে: “বিএনপি জন্ম নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণের রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে” । দলটি তাদের ৩১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে “মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র” হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে ।
জিয়াউর রহমানের দর্শন কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তিরও বার্তা বহন করে। তিনি অর্থনীতিতে বেসরকিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । তাঁর আমলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য আসে ।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের দর্শন। এটি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা地域 নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বার্তা বহন করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দর্শন একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জিয়াউর রহমানের ভাষায়: “আমাদের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিকভিত্তিক। এ জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে জাতিগত চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিক বোধ, অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের উন্মাদনা”। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এই দর্শন কেবল অতীতেরই নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা।